ডেস্ক রিপোর্ট//আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ প্রশাসন গোছানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমে উন্নয়ন এবং দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে— জেলা প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ, বাজেট বরাদ্দ এবং মাঠ প্রশাসনের কার্যকারিতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া। নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক না হলেও মাঠ গোছানোর কাজ এগিয়ে রাখতে চায় সরকার, যাতে কাজটি সহজ হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, মাঠ প্রশাসন গোছানোর জন্য সরকার যেসব পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—দক্ষ কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যা তাদের দায়িত্ব পালনে সহায়ক হবে।
এর পরেই রয়েছে বাজেট বরাদ্দ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত বাজেট। আগামী নির্বাচন উপলক্ষে সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটেও বিশেষ বরাদ্দ রেখেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ গোছানোর অংশ হিসেবে রয়েছে উপর মহলের কার্যকর নির্দেশনা। ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রমের জন্য কিছু কিছু নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, যা কেন্দ্র ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় করবে। যদিও এই নির্দেশনা সময় ভেদে পরিবর্তন করা হতে পারে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করতে মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এসব পদক্ষেপ উন্নয়নমূলক কাজে গতি আনবে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে মাঠ প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সূত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচিত হয় জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদটি। ডিসি পর্যায়ে আগামী কিছু দিনের মধ্যে কিছু রদবদল করার কথা ভাবছে সরকার। আর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এ পদে ব্যাপক রদবদল হতে পারে। এ লক্ষ্যে এখন যোগ্য কর্মকর্তা বাছাই (ফিট লিস্ট) করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে মাথায় রেখেই মূলত মাঠ প্রশাসনে পরিবর্তনের প্রস্তুতি শুরু করেছে সরকার।
জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার গুরুত্বপূর্ণ পদ হলেও জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে জেলা প্রশাসক সরকারের মুখপাত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকারের যেকোনও সিদ্ধান্ত ডিসিদের মারফত বাস্তবায়ন করা হয়। যে কারণে বিশ্বস্ত, দক্ষ, চৌকস ও সাহসী কর্মকর্তাদের ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা হয়। প্রশাসনে বর্তমানে ২৪তম, ২৫তম এবং ২৭তম বিসিএস কর্মকর্তারা ডিসি পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে ২৪ ও ২৫তম বিসিএসের কর্মকর্তারা গত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের (২০০১-০৬) আমলে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। আর ২৭তম বিসিএসের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন এক-এগারোর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (২০০৭-০৮) সময়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ২৪তম বিসিএস কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে সেখানে নতুন ডিসি নিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। একই সঙ্গে আরও কিছু জেলায়ও পরিবর্তন আসতে পারে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের ২১ জেলায় বর্তমানে যারা ডিসির দায়িত্ব পালন করছেন, তারা গত মার্চে উপসচিব থেকে পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম সচিব হয়েছেন। তবে ডিসির পদটি উপসচিব পদমর্যাদার। ফলে এই জেলাগুলোতে বদলির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
এই জেলাগুলো হলো- হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, কক্সবাজার, ঝিনাইদহ, পঞ্চগড়, মাগুরা, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পিরোজপুর, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, ঢাকা, মাদারীপুর, গাইবান্ধা, কিশোরগঞ্জ ও জয়পুরহাট। এসব জেলার ডিসিরা ২৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা। ডিসি পদে এই ব্যাচের ২৬ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনের পদোন্নতি হয়নি।
এদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তখন এত যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ এবং সময় কোনোটাই ছিল না। কিন্তু ভোটের আগে সরকার যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি করবে। এক্ষেত্রে যারা উপযুক্ত নন তাদের সরিয়ে দক্ষদের দেওয়া হবে।
অন্যদিকে, যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ২১ জন ডিসি অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কখন তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে। পদোন্নতির পর নিশ্চিত বদলির চিন্তা তাদের মধ্যে এলে সেভাবে কাজে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ থাকে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই ভোটের আগে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক পর্যায়ে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। যখন যে জেলায় প্রয়োজন হবে সেখানে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। সামনে হয়তো ৪-৫ জন ডিসি বদল হতে পারে। এর মধ্যে শরীয়তপুরে নতুন ডিসি নিয়োগ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাছাই তালিকা হয়ে গেলে যারা যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের জায়গায় নতুন ডিসি দেওয়া হবে।
জনপ্রশাসন সচিব বলেন, বিতর্কের সুযোগ এড়াতে খুব নিবিড়ভাবে বাছাই করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনও অভিযোগ নেই তাদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পেশাদার ও সর্বোচ্চ যোগ্য লোককে বাছাই করা হচ্ছে। যোগ্য কর্মকর্তা বাছাই করাও একটি কঠিন কাজ। এ জন্য একটু সময় লাগছে। তবে জুলাইয়ের মধ্যেই বাছাই কাজ শেষ করা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২৫ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তা ডিসির দায়িত্বে আছেন। ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকে ডিসি নিয়োগ দিতে তাদের ফিট লিস্টও তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
অপর একটি সূত্র জানায়, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তাই নির্বাচনি দায়িত্বে থাকতে অনিচ্ছুক। তারা মনে করেন, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের পর অনেক সময় বিশেষ করে সরকার পরিবর্তন হলেই ঢালাওভাবে ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরের মতো সিদ্ধান্তের মুখে পড়তে হয়। অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়। পদোন্নতিতেও অসুবিধায় পড়তে হয়। ফলে অনেকেই নির্বাচনি দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চান। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত হলে দায়িত্ব পালন ছাড়া উপায়ও থাকে না। আগামী নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন কিনা, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশন (ইসি) এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। বর্তমান আইন অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রধান করে কমিটি করার বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে। এই সংশোধনী এনে সম্প্রতি ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারাই ভোটকেন্দ্র স্থাপন করবেন।
আগে ইসির কর্মকর্তারাই এ কাজটি করতেন। কিন্তু গত নির্বাচনে ইসি প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের এই কাজে যুক্ত করেছিল, যা নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এবার সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ইসির কর্মকর্তাদের হাতে।
এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সরকারি কর্মচারী হিসেবে সরকারের সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাই একজন সরকারি কর্মচারীর কাজ। কিন্তু সেভাবে দেখা হয় না। দেখা হয় দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে। এখানেই সমস্যা। ফলে ডিসিগিরি করতে এসে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়। নির্বাচন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বটে। এতে নানা ধরনের ঝুঁকিও রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছেন কেউ কেউ। বরিশাল বিভাগের একজন জেলা প্রশাসক পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একটি নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক ডিসির কপালেই তা জোটে না। এর মধ্য দিয়ে একজন কর্মকর্তার দক্ষতারও প্রমাণ মেলে। যা তার পরবর্তী ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। তবে এর ব্যতিক্রম হলে তো কিছু করার নাই।
উল্লেখ্য, গত সরকারও নির্বাচনের কয়েক মাস আগে অনেক জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন এনেছিল। অবশ্য গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের ডিসিদের প্রত্যাহার করে পর্যায়ক্রমে সব জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়েছে। তবে এ নিয়োগ নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে কর্মকর্তারা হাতাহাতি, হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলা করেছেন। তখন ৯ জন ডিসির পদায়ন বাতিল করা হয়েছিল। রদবদল করা হয়েছিল চার জেলার ডিসিকে। যা জনপ্রশাসনে বিরল ঘটনা বলে মনে করছেন অনেকে।